পিচকারি যে দোকানে কিনতে পাওয়া যায় এটা আমার ধারনা ছিল না। আমি তখন অনেক ছোট, হয়তো ইস্কুলে ভর্তি করা হয়নি। গ্রামের পাড়াগাঁয়ে মাঝে মাঝে বিভিন্ন জিনিসের ধুম পড়ে যেত। এই ধরুন যখন পাট এর মশুম আসে তখন তীর ধনুক বানানোর ধুম, দোলের আগে পিচকারি, আম এর সময় ঝিনুক ঘসে আম ছেলা যন্ত্র বানানোর।
যখন নতুন পাটকাঠি গ্রামের রাস্তায় আর উঠানে শুকানোর জন্য ছড়াছড়ি থাকে, ঠিক তখনই ধুম পড়ে যায় বাচ্চাদের তীর আর ধনুক খেলার। ধনুক বানানো খুবিই সহজ, প্রথমে দুহাত লম্বা কচি বাঁশ কে আগাগোড়া দুই ফালি বা চার ফালি করে চিরে নিতে হবে লম্বালম্বি। তার পর প্রত্যেকটা বাঁশের ফালি কে কাটারি / দাঁ দিয়ে চেঁচে মসৃণ আর পাতলা করে নিতে হবে, যাতে খুব সহজে বেঁকানো যায় ধনুকের মত। বাঁশের ফালির দুই প্রান্থে দড়ি বাঁধার জন্য খাঁজ কেটে নিতে হবে, যাতে দড়ি বাঁধা যায়।
এবার শুঁকনো পাট পাকিয়ে পাকিয়ে দড়ি বানাতে হবে, খেয়াল রাখতে হবে যাতে পাটের দড়ি বেশি মোটা না হয়ে যায়। যত শরু দড়ি, তত ভালো ধনুক হবে। বাঁশের দুই প্রান্থে টানটান করে দড়ি বাঁধলেই ধনুক তৈরি, আর তীর হিসাবে অফুরন্ত পাটকাঠি। এই সব কাজের জন্য সব পাড়াতে একটা করে পালের গোদা থাকতো, আমাদেরও ছিলো।
গ্রামে বাচ্ছাকাচ্ছাদের মধ্যে চলতেই থাকতো কিছু না কিছু কার্যকলাপ। দোলের সময় পিচকারি বানাবার একটা ধুম পড়তো। সকাল হলেই দেখা যেত বাঁশ বাগানে ঘুরঘুর করছে ছেলেপিলে, কিম্বা কারো বাড়িতে বাঁশ কাটা থাকলে সেখানে। গ্রামে তো সকলের বাঁশ বাগান থাকে না, যাদের থাকে তাদের বাড়িতে যদি কোন ছোট ছেলে থাকে, দেখা যাবে হঠাৎ করে গ্রামের সকল সমবয়সী ছেলে তার বন্ধু হতে শুরুকরে রাতারাতি। এতদিন যারা বলতো “সঞ্জয় খেলতে পারে না ঠিকঠাক, লুকোচুরি খেলায় দুধভাত” তারাই সঞ্জয়ের প্রানের বন্ধু হয়ে উঠতো হঠাৎ করে। পিচকারির জন্য কচি বাঁশ চাই, এটাই আসল উদ্দেশ্য।
একটু সরু কচি বাঁশ চাই, কঞ্ছি হলে চলবে না। সোজা লম্বা হওয়া চাই, ভিতরটা বেশ ফাঁপা হওয়া চাই। এমন বাঁশ সন্ধান করা খুই পরিশ্রমের কাজ। সবাই মিলে দল বেঁধে করতে হতো সেই কাজ। সবে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ। এক হাত লম্বা একটি বাঁশের টুকরো, একদিকে একটি গিঁট/গেরো রাখতে হবে আর দ্বিতীয় গিঁট কেটে ফেলতে হবে। একপাশের গিঁটে ক্ষুদ্র ছিদ্র ও অন্যপাশ উন্মুক্ত। এমন বাঁশের চুঙায় পানি বা তরল ঢুকিয়ে কাঠির প্রান্তে এক ফালি কাপড় জরানো কঞ্ছি বা পাটকাঠি দিয়ে ধাক্কা দিলেই, ভিতরে থাকা তরল সামনের গিঁটে ক্ষুদ্র ছিদ্র থেকে প্রচণ্ড গতি নিয়ে বেরিয়ে আসবে। এটাই ছিল আমার শৈশবের পিচকারি। এই পিচকারি খেলা চলতো বেশ কয়েকদিন। স্নানের সময় প্রায় সব ছেলের কোমরে গামছায় গোজা থাকতো এই পিচকারি। পুকুরে নেমেই খেলা শুরু, একে অপরকে লক্ষ্য করে পিচকারি অস্ত্র চালনো।
চৈত্র-বৈশাখ মাস আমের সময়। চড়কের মেলা থেকে কিনতেই হবে একটা ছোট্ট ছুরি। ছোট্ট ফল্ডিং ছুরি, আকাশী নীল রঙের খাপ, ছুরি ভাঁজ করলে এই আকাশী নীল রঙের খাপের ভিতরে ছুরি ঢুকে পড়ে। অনায়াসেই এই ছুরি পকেটে নিয়ে এই আম বাগান, ওই আম বাগান ঘুরে বেড়ানো যায়। সঙ্গে থাকবে আরও অন্য দুটি জিনিস, প্রথমটি লবন আর জিরেমরিচ গুড়ো মেশানো একটা কাগজের পুরিয়া, আর দ্বিতীয়টি ঘষা ঝিনুকের আম ছেলা যন্ত্র।
সেই সময় গ্রামের পুরনো বড় পুকুরে প্রচুর ঝিনুক আর শামুক পাওয়া যেত। অনেক ঝিনুকে ছোট ছোট মুক্তও পাওয়া যেত। আমি নিজে দেখেছি ঠাকুমা আর মা, হাসের জন্য পুকুর থেকে ঝিনুক তুলিয়ে আনাতেন লোক দিয়ে, তার পর নিজের হাতে সেই ঝিনুক ভেঙ্গে খাওয়াতো বাড়ির পোষা হাস কে। মাঝে মাঝেই এই ঝিনুক থেকে ছোট ছোট সর্ষের দানার মত মুক্ত খুজে বার করতেন মা আর কাকিমা। আমি পাশে দাড়িয়ে দেখতেম দার্শনিকের মত। কাকিমা একবার একটা মুক্ত পেয়েছিলেন মুশুর ডালের মত সাইজের, এবং পরে সেই মুক্ত কাকিমার নাকের নথে জায়গা পেয়েছিলো।
একটি ঝিনুক থেকে দুটি আম ছেলার যন্ত্র তৈরি করা যায়। পড়ে থাকা ঝিনুকের স্তূপ থেকে প্রথমে বেছে নিতে হবে সব থেকে বড় এক ফালি ঝিনুক। তার পরে পুকুরের সান বাধানো নিরিবিলি ঘাটে জেতে হবে, বেশি লোকজন যে পুকুর ঘাটে থাকে সেই ঘাটে যাওয়া চলবে না। ঝিনুকটিকে ভালো করে পরিস্কার করে, ঝিনুকের পিঠের দিকটা খরখরে সানের উপরে ঘোষতে হবে ততক্ষণ, যতক্ষণ ঝিনুকের পিঠে একটা গোল ছিদ্র না তৈরি হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় দাত কিড়মিড় করা খসখসে শব্দ হবে, এই জন্য নিরিবিলি পুকুর ঘাট বেছে নিতে হতো। এই যন্ত্র তৈরি করার সব থেকে ভালো সময় দুপুরে খাওয়ার পরে, যখন পুকুর ঘাটে কেউ থাকে না।
এবার ছিদ্র করা ঝিনুকের পিঠ, একটি কাঁচা আমের উপরে একটু চেপে ধরে টানলেই আমের ছাল উঠে আসবে। এখন যেমন শসা ছেলা যন্ত্র পাওয়া যায় কিনতে, এই পিঠ ঘষা ঝিনুক ঠিক ওই একই জিনিস।
শৈশব চলে গিয়েছে, সেদিনের গ্রাম বাংলাও আজ বদলে গিয়েছে। মাঝে মাঝে যখন গ্রামের বাড়ি যাই, দেখি চারপাশটা পাল্টে গিয়েছে। আমি বড় উঠনের মাঝখানে দাড়িয়ে চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করি, কোথায় ছিল কলম গাছের আম বাগান, কোথায় ছিল বুড়ো নারকেল গাছ, কোন দিকে ছিল জাম আর বেল গাছ। ঝাপসা একটা 3D সিনেমার মত চলতে থাকে আমার বন্ধ চোখের ভিতরে, চোখ খুলতে ভয় লাগে, আমি তো জানি এটা স্মৃতি, বাস্তব তো অন্য কিছু।
+ There are no comments
Add yours