প্রথম টেলিফোনের গল্প

Estimated read time 1 min read

আজ আসে কাল আসে করতে করতে হঠাৎ একদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখি ঘর আলো করে আছে আমাদের প্রথম লাল টুকটুকে টেলিফোন। গত এক সপ্তাহ ধরে এই চমকটি পাওয়ার জন্য বাড়ি শুদ্ধ লোক অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলাম আমার সবাই। রাতে খাওয়ার সময় এক চোট আলোচনা, ছুটির দিন দুপুরে খাওয়ার সময়ও সেই একই আলো আর চোনা, টপিক ওই একটাই, টেলিফোন কবে দিতে পারে! পাড়ায় প্রথম টেলিফোন। এতদিন শুধু মাত্র উত্তম কুমারের সিনেমাতে দেখেছি, আর আজ আমাদের বাড়িতেও। আরিব্বাস!! টেলিফোন। টেলিফোনে কিভাবে কথা বলতে হয় তা আমরা শিখে নিয়েছি সিনেমা আর নাটক দেখে দেখে। কিরিং কিরিং করে টেলিফোন বেজে উঠলে, ধীর স্থির ভাবে গিয়ে টেলিফোনের ধরার অংশটুকু তুলে নিয়ে কানে ধরতে হবে আর খুব স্বাভাবিক ভাবে বলতে হবে-

“হ্যালো”

বাড়ি ঢুকেই দেখি সকলের মুখে মিটিমিটি হাসি, দুই একজন প্রতিবেশী বসে আছে বারান্দায়। সবে মাত্র চায়ের পাঠ শেষ হয়েছে। সবাইকেই ছোট ছোট কাগজের চিরকুটে ফোন নম্বর লিখে দেওয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। তখনো পর্য্যন্ত আমাদের বাড়ি থেকে কাউকেই কোনো ফোন করা হয়নি। আমাদের লাল টুকটুকে ফোন থেকে প্রথম ফোন করেছিলেন আমাদের এক প্রতিবেশী, নাম লালবাবু। সে সময় আমাদের কোনো আত্মীয় বা পরিচিত কোনো মানুষের বাড়িতে ফোন ছিল না, তাই ইচ্ছা থাকলেও আমরা কাউকেই ফোন করতে পারিনি। প্রতিবেশী লালবাবু যখন লাল ফোনের কালো বোতাম গুলো প্রথম বার টিপে টিপে প্রথম ফোন করলো, সপরিবার আমরা তার চারপাশে দাঁড়িয়ে। ছোট চৌকির উপরে রাখা আছে ফোন, পাশে একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে লালবাবু বসে। একদম সিনেমার কায়দায় রিসিভার তুলে নিয়ে বুক পকেটে থেকে একটা ছোট্ট ডাইরি থেকে নম্বর দেখে ডায়েল কিরেছিল। উত্তম কুমার স্টাইলে যতটা সম্ভব নাটকীয় কায়দায় বলেছিল-

“হ্যালো”

প্রায় এক দুই সপ্তাহ আমাদের বাড়িতে মেলা চলেছিল সঙ্গে চা বিস্কুটের পার্টি। আমি ছোট ছোট করে কাগজ কেটে তাতে আগে থেকে নম্বর লিখে রাখতাম। চাইবা মাত্র যাতে প্রতিবেশীকে আমাদের ফোন নম্বর দিতে পারি। সে সময় আমাদের নম্বর ছিল 552 0734, পরে অবশ্য এই নম্বরের আগে একটা 2 যোগ হয়েছিল। কলকাতার STD কোড জুড়ে শেষমেশ হয়েছিল 03325520735. এখানে 033 কলকাতার কোড, 2552 বারাসতের কোড আর 0734 আমাদের নম্বর। ছোটবেলায় যেমন আমরা নামতা মুখস্ত করি আর সেটা মনে থেকে যায় সারাজীবন, ঠিক তেমনি এই প্রথম ফোন নম্বর চিরদিনের জন্য আমার মনে আঁচড় কেটে দিলো। যাই হোক, আমাদের প্রথম out going call করেছিলেন আমাদের প্রতিবেশী লালবাবু, আবার প্রথম in comming কল ও এসেছিল আমাদের কোনো এক প্রতিবেশীর। প্রথম incomming কল কে ধরেছিল মনে নেই, তবে ছুটে গিয়ে কোনো এক প্রতিবেশী কে ডেকে এনেছিলাম এটা মনে আছে। প্রথম প্রথম বেশ মজা পেতাম অন্যের ফোন এলে ডেকে দিতে। কিন্তু কয়েক মাস যেতে না যেতেই এই ভালোলাগা আর ভালো লাগতে লাগলো না। সময় নেই অসময় নেই ওমুক কে ডেকে দিন, তমুক কে ডেকে দিন। খেতে বসেছি, ঘুমাচ্ছি, অন্য কাজ করছি, কিছুতেই রেহাই নেই। ডাকতে দেরি করলেই দ্বিতীয়বার ফোন। কোনোকোন সময় এমনও হয়েছে যে সাইকেল চড়ে পাড়ার শেষ প্রান্তর মানুষকে খুঁজে তাকে সাইকেলে চড়িয়ে বাড়িতে এনে ফোনে কথা বলিয়েছি। সে সব এক দিন গেছে। পেট্রোল ছড়িয়ে দিয়ে এক কোনায় যেমন আগুন লাগলে যত তাড়াতাড়ি আগুন ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক তেমনি আমাদের ফোন নম্বর ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের নানা প্রান্তে। জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল সেই সময়। ৯মাস ৬মাসে আমাদের নিজের একটা ফোন আসতো, আর সারা বছর ভোর থেকে মাঝ রাতে পর্যন্ত অন্যের ফোন, একে একটু ডেকে দিন না ওকে একটু ডেকে দিন না।

পুরনো অ্যালবাম থেকে ছবি

প্রথম দিকে আমরা out going করার জন্যও কারো কাছ থেকে পয়সা নিতাম না। কিন্ত যখন বিলের বহর আর বহন করা অসহ্য হয়ে উঠেছিল, তখন মান সম্মান সব জলাঞ্জলী দিয়ে ঠোঁটকাটা হতে হয়েছিল। এই নিয়ে পাড়ায় আবার কানাকানি কথাও উঠেছিল, আমরা নাকি পয়সা চাই ফোন করলে। সে যুগে লোকাল ফোন ৩ মিনিটে ২টাকা চার্জ করতো BSNL. পাড়ার কানাকানি কানে আসার পর থেকে আমার আর পয়সার কথা কাউকে বলতাম না। একটা ছোট মোবিলের কৌটো পরিষ্কার করে সুন্দর করে সাজিয়ে ফোনের পাশে রেখে দিয়েছিলাম। কৌটোর উপরে পয়সা ঢোকানোর জন্য একটা ছিদ্রও করা ছিল, যাতে সবাই বুঝতে পারে ওটা পয়সা ফেলার কৌটো। বেশিরভাগ লোক পয়সা দিত না, আবার ফোন করে গল্প করতে বসে যেতো। ভদ্রতা রক্ষা করতে আবার চাও খাওয়াতে হতো তাকে। কিছু লোক তো মুখের উপর বলেই দিত, “খুচরা নেই, পরে দিয়ে যাবো খোকা!”। এই ‘পরে’ কিন্তু আজ পর্যন্ত আসেনি। আমার এক পাড়া সম্পর্কের মামা আছে, সে তার মুদিখানার ব্যবসা সংক্রান্ত ফোন করতো আর ডেকেও দিতে হতো। এখানে ডেকে দেওয়া ফ্রী, আর ফোন করলে মামা একটা খাতায় লিখে রেখে যেত। হালখাতার সময় মামার মুদিখানার খাতা আর আমাদের ফোনের খাতার এক সাথে হিসাব হতো।

মানুষের জীবনে অভিজ্ঞতার শেষে নেই। অভিজ্ঞতার জন্য দেশে বিদেশে ঘোরা লাগে না, একটু মনের জানাল খুলে রাখলেই অভিজ্ঞতা আর স্মৃতি মনে জমতে থাকে। এই টেলিফোন নিয়ে ছোট বড়, ভালো মন্দ, মিষ্টি তেতো অনেক স্মৃতিই আছে। মিষ্টি অভিজ্ঞতা আর স্মৃতি মনে রাখতে চাই, অন্য তেতো স্মৃতি মুছে যাক। আজ সকলের হাতে স্মার্ট ফোন। পাড়ার সকলেই আজ হয়তো ভুলে গিয়েছি সেই অতীতের অকেজো 552 0734 কে। আজ এমন অনেক মানুষদের সাথে পথ চলতে সন্ধ্যা সকালে চোখাচোখি হয়, যাদের কে কোন এক অতীতে নিজের কাজ ফেলে দৌড় ডেকে এনে ছিলাম ফোনের জন্য। আজ হয়তো কোনো ছোট কারণে মনোমালিন্য। কবিগুরুর ছন্দে বলতে গেলে – “পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়, ও সেই চোখে দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়?”

সঞ্জয় হুমানিয়া
১৭ অগাস্ট ২০১৮, বেঙ্গালুরু, ইন্ডিয়া

★ আমার লেখায় অজস্র বানান ভুল থেকে যায়, পাঠকের চোখে পড়লে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন ★

+ There are no comments

Add yours