সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশে সিনেমায় রাজা তার এক বিজ্ঞানী গবেষক গবুচন্দ্র জ্ঞানোতীর্থ জ্ঞানরত্ন জ্ঞানবুদ্ধি জ্ঞানোচুড়োমণির সাহায্যে একটি মগজ ধোলাই যন্ত্র আবিস্কার করেছিলেন। এই যন্ত্রে আলাদা আলাদা মানুষের জন্য আলাদা আলাদা মন্ত্র ছিল, যা প্রয়োগ করলে সেই সব মানুষ নিজের বোধ হারিয়ে ফেলে রাজার দাসত্ব স্বীকার করবে। রাজার আদেশই তাদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়াবে।
কয়েক মাস আগে বাস স্ট্যান্ডে বসে থাকা এক সহযাত্রী হঠাৎ এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, “হ্যালো, আপ বাঙালী হো?” উত্তরে আমি মিটিমিটি হেসে সম্মতি জানিয়েছিলাম। তার পর পরিচয় আদান প্রদান এবং জীবিকার খবরাখবর। আমি একটু মজার ছলেই বলেছিলাম, “আমি বাঙালী শিল্প করি”। পরে অবশ্য সহযাত্রী কে ব্যাপারটা ভেঙ্গে বুঝিয়ে দিতে হয়েছিলো। “হ্যাম ভাজিয়া কে দুকান মে কাম কারতে হ্যাঁই”। সহযাত্রী একটি নেটওয়ার্ক ব্যবসা অর্থাৎ network business এর সঙ্গে যুক্ত। পরনে মলিন একটি সুট, প্যান্ট ও লাল টাই। উনি আমাকে এই ব্যবসার একাধিক শুফল এবং শুন্য কূফল বোঝালেন। আমি বেশ চমৎকার শ্রোতা হয়ে শুনলাম ওনার বক্তব্য। শেষে ওনাকে বিষয়টি বিস্তারিত ব্যাখ্যা করতে বললাম। উনি বললেন যে, এভাবে তো রাস্তার মাঝে সব কিছু বলা সম্ভব না, আমি যদি ওনাকে মাত্র ১ ঘণ্টা সময় দিতে পারি কোন এক নির্জন স্থানে, তবে উনি পুরো বিষয়টি বুঝিয়ে বলবেন। আমার মধ্যে তখন যথেষ্ট কৌতূহল তৈরি হয়ে গিয়েছে। আমি অনুরোধ করলাম, প্লিজ আমাকে একটু তো সূত্র দিন, কিভাবে আমি কয়েক মাসে কোটিপতি হতে পারবো। উনি খুবই স্বাভাবিক ও স্থির ভাবে বললেন, ১ ঘণ্টা সময় কোন এক নির্জন স্থানে। অনেক চেষ্টা করেও আমি তার এই suspense কোন মতেই ভাঙতে পারলাম না। আমার বাস চলে আসায়, সেদিনের মত বিদয় নিলাম।
সপ্তাহ খানেক পর, রাস্তার মোড়ে চায়ের দোকানে সন্ধ্যায় হরলিক্স খাচ্ছি, এমন সময় একটি অপরিচিত নম্বর থেকে একটি ফোল কল এলো। ট্রু কলারের আশীর্বাদে একটি নাম ভেসে উঠলো স্ক্রিনে “Siva”. কিছু না ভেবেই ফোন ধরে নিলাম, তার পর পরিচয় বিনিময়ের পর মনে পড়লো এই সেই বাস স্ট্যান্ডের আগুন্তুক বন্ধু। আমার কোন বারণ শুনলেন না উনি, সেই সন্ধ্যায়ই দেখা করতে চান, এবং মাত্র ১ ঘণ্টা চান। আমি কোমল হৃদয়ের মানুষ, না করতে পারলাম না, ডেকে নিলাম নিজের ভাঁড়া ঘরে। প্রায় ২ ঘণ্টা ধরে আমার মগজ ধোলাই করা হলো, মাসিক আয় দেখানো হলো প্রায় কোটি টাকা। এখানে একটা কথা বলে রাখি, বাংলায় একটা কথা আছে – ” ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা ” উচিৎ নয় কিম্বা ” নেংটার নেই বাটপাড়ের ভয় ” আর এটাই হয়েছে আমার সাথে। সকালে খেয়ে ভাবতে হয় দুপুরে কি খাবো? আর সেই লোক কে বলছে ১০০০০ টাকা দিয়ে নেটওয়ার্ক ব্যবসাতে অর্থাৎ network business এ যুক্ত হতে। শেষমেশ উনি আশাহত হয়ে ফিরে গেলেন।
৩ মাস পর। আমি ভাড়া ঘর ছেড়ে একটি সস্তার একটি PG তে এসেছি। বেঙ্গালরের PG মানে শেয়ারিং ঘর সঙ্গে খাওয়াদাওয়া। খুবই কম খরচায় দিন কাটাতে আপনি নানা ধরণের PG পাবেন এখানে। সবে এক সপ্তাহ হয়েছে এখানে। একদিন ছাদের উপরে দাড়িয়ে স্নিগ্ধ বাতাস খেয়ে পেট ভরাচ্ছি, ওমনি কানে এলো, কেউ যেন আমার নাম ধরে ডাকছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি, পাশের বাড়ির ছাদে আমার সেই পরিচিত নেটওয়ার্ক ব্যবসায়ী অর্থাৎ network business বন্ধু। আমি অবাক! পাঁচিলে একটি কাকা। তখনই তিনি ২ মিনিটের মধ্যে আমাদের ছাদে উপস্থিত। সেদিন রবিবার, আর প্রত্যেক রবিবার রবিবার তাদের আপিসে সেমিনার হয়। এই সেমিনারে দেশের বড় বড় তাবড় তাবড় সব নেটওয়ার্ক ব্যবসা অর্থাৎ network business এর পাণ্ডারা আসেন, আমাদের মত মানুষদের মগজ ধোলাই করতে। এবার আর নিস্তার পেলাম না। আমাকে যেতেই হলো সেই সেমিনারে।
সেমিনার চললো খুব ধুম ধাম করে। হিন্দি সিনেমার মত এক এক নেটওয়ার্ক ব্যবসাীর অর্থাৎ network business man দের video documentation দেখানো হল। কিভাবে তারা আমাদের মত মানুষ থেকে আজ কোটিপতি। অমিতাভ বচ্চনের মত তারা যেন ডাইলগ মারছে, “আজ মেরে পাস বিল্ডিং হ্যায়, প্রপার্টি হ্যায়, ব্যাঙ্ক ব্যালান্স হ্যায়,বাংলা হ্যায়, গাড়ি হ্যায়, তুমহারে পাস কেয়া হাই? হাঁ ?” আমি মনে মনে বললাম, মেরে পাস মা হাঁই। সেমিনার শেষে সবাইকে একটা ফর্ম দেওয়া হল, ফর্ম ফ্রী, তবে সঙ্গে দেওয়া হল একটি motivating speech এর একটি DVD এবং একটি বই। এই দুটির মূল্য মাত্র ৫০০ টাকা।
কিছু মানুষ কিনছে, কিছু মানুষ অসহায় হয়ে কিনছে, আর কিছু মানুষ প্রাণপণে চেষ্টা করছে নিজের ৫০০টা টাকা বাঁচাতে। সেমিনারের পরে আমাকে সামনে বসিয়ে শেষ বারের মত মরণ কামড় বসিয়ে দিলো আমার এই পরিচিত ভদ্রলোক। আমি যেন কিছুতেই ছাড়াতে পারছি না তার এই কামড়। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, হয়তো আজ আর ৫০০ টাকা বাঁচাতেই পারবো না। হয়তো কোটিপতি হওয়ার প্রথম ধাপ আজ আমাকে চড়তেই হবে। আমি দাতে দাত চেপে বসে আছি। আমার সুভাকাঙ্খি বন্ধু আমাকে উপদেশ দিয়েই চলেছে। কয়েক মুহূর্তে মনে হল এই বুঝি আমি হড়কে গেলাম তার ভেজা কথায়। পায়ের পাতাটা শিড় শিড় করে উঠলো। আমি চোখের সামনে ঝাপ্সা দেখছি, শুধু কানে আসছে কোটিপতি হওয়ার সহজ উপয়ায়, মাত্র কয়েক ধাপ দূরে। আর ছোট্ট একটি পদক্ষেপ, আর আমি কোটিপতি হওয়ার রাস্তায় হাটতে শুরু করবো।
হঠাৎ, সব চুপচাপ। চোখের ঝাপ্সা ভাব কাঁটিয়ে দেখি আমার পরম বন্ধু আমার সামনে বসে নেই। ঘরের কোনে রাখা জলের পাত্র থেকে গ্লাসে জল ঢেলে জল খাচ্ছে। জল খাওয়া শেষ করে আমার জন্য এক গ্লাস জল নিয়ে আমাকে দিলেন। আমি এক গ্লাস জল খেয়ে সেমিনারের খাওয়াদাওয়া শেষ করলাম। উনি আমাকে বললেন, ” তো, সঞ্জয় স্যার, আপ কেয়া আভি ঘর যাও গে? ” আমি বললাম, হ্যাঁয় যাবো তো। উনি তখন আমতা আমতা করে বললেন, তিনি একটু এখন এখানে থাকবেন, একটু পরে যাবেন। আমি একা ফিরতে পারবো কি না একবার জিজ্ঞাশা করে নিলেন। আমি নিরুপায় হয় সম্মতি জানালাম, মনে মনে ভাবছি –
” আনার সময় বাইকে চাপিয়ে এনেছো আর ফেরার সময় আমি হাটি হাটি পা পা? কাভি নাহি!! হ্যাম হাটকে নাহি জায়েগা, তুমাহারে পাস সে টাকা লেকে অটো মে যায়েগা”
বিদয় নেওয়ার সময় আমার বাস স্ট্যান্ডের এই কোটিপতি বন্ধু কে বললাম, আপনি একটু বাইরে আসবেন? একটু কথা ছিল। উনি আমাকে দরজার বাইরে পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এলেন। দুজনেই যখন কাঁচের দরজার বাইরে এলাম, আমি আমার শেষ কামড় বসিয়ে দিলাম। মাত্র ৩ মিনিট সময় নিয়ে আমি আমার করুণ দুর্দশার বর্ণনা দিয়ে নিরুপায় ভাব করে বললাম, যে আপাতত আমি এই নেটওয়ার্ক ব্যবসা করতে অক্ষম। আমার মাথায় প্রচুর দেনা, PG মালিক advance চাইছে কিছু টাকা। পকেট একদক খালি, দিনকাল খুবই খারাপ। আসলে আমার উদ্দেশ্য ছিল অটো ভাড়া আর একটি ঠাণ্ডা পানিয় আদায় করা। কিন্তু হঠাৎ আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো, যে PG মালিক খুব চাপ দিচ্ছে ২০০০ টাকার জন্য, আর উনি যেন আমাকে একটু উপকার করেন। আমি নিঃশ্বাস না নিয়ে একই কথা বার বার তার চোখের দিকে তাকিয়ে আওড়ে গেলাম। কয়েক মুহূর্তের জন্য উনি যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলেন। ওনার অজান্তেই ওনার হাত পকেটে ঢুকে গিয়ে মানি ব্যাগটি বার করে এনেছিল। মানি ব্যাগ খুলে আমাকে হয়তো দেখাতে চাইছিলেন যে তার কাছে এখনি ২০০০ টাকা নেই।
সত্যি তার ব্যাগে ২০০০ টাকা ছিল না। ছিল ২ টি ৫০০ টাকার নোট আর কয়েকটি ১০-২০ টাকার নোট। উনি হয়তো বলতে শুরু করেছিলেন, যে ২০০০ টাকা তো এখন নেই, আমি ওনার কথা শেষ করার আগেই ১০০০ টাকার আবদার করে ফেললাম, আর সঙ্গে আমার দুর্দশার বর্ণনা। দেখলাম উনি মন্ত্রমুগ্ধের মত দুটি ৫০০ টাকা ব্যাগ থেকে বার করে আমার হাতে দিয়ে দিলেন। আমিও টাকা পেয়ে সটান পকেটে ভরে ফেললাম। তার পর কয়েক সেকেন্ড পরে যেন তিনি কেমন ঘোর কাঁটিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে, যে কি হয়েছে কয়েক মুহূর্ত আগে। ফ্যালফ্যাল করে একবার নিজের মানি ব্যাগের দিকে তাকিয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমি মিষ্টি একটি হাসি দিয়ে দু হাতে তার ডান হাত ধরে ধন্যবাদ জানালাম। তিনি তেমনি একটি হতভম্ব ভাবের মধ্যে একটু হাসার চেষ্টা করলেন। বিদয় জানিয়ে ফেরার সময় বলে এলাম, আমি চাকরি পেলেই ২,৩ মাসের মধ্যে ফিরিয়ে দেবো টাকা। ফেরার পথে অটোতে বসে বসে ভাবছি, আমিও তাহলে মগজ ধোলাই করতে পারি। সবাই ভালো, শুধু আমি না হয় একটু খারাপ হলাম, ক্ষতি কি?
দুমাস পরে একটা ছোটোখাটো চাকরি জুটিয়ে ফেললাম। একদিন সন্ধ্যায় এই নেটওয়ার্ক ব্যবসায়ী অর্থাৎ network business বন্ধু কে ফোন করে জিজ্ঞাসা করলাম তার Google Pay বা PhonePe অ্যাকাউন্ট আছে কি না। বন্ধু বললো এই নম্বরেই আছে অ্যাকাউন্ট। কথা বলতে বলতেই ১০০০ টাকা পাঠিয়ে দিলাম ওর অ্যাকাউন্টে। কথা শেষ করে ফোন কাটার আগে ও বললো –
“থ্যাংক ইউ, সঞ্জয় স্যার”
সঞ্জয় হুমানিয়ায়া
১১ই নভেম্বার ২০১৮ – বেঙ্গালুরু
+ There are no comments
Add yours