তখন ইস্কুলে পড়ি, তখনও ট্রেনে একা যাতায়াত শুরু হয়নি আমার। মামার বাড়ি জেতাম বাসে করে মা বাবার সঙ্গে, পিসীর বাড়ি জেতাম ভ্যানে করে ঠাকুমার সাথে আর ইস্কুলে জেতাম সাইকেলে করে একা একা। আমাদের আত্মীয়দের বাড়ি যেতে আসতে ট্রেনের ব্যাবহার নেই বললেই চলে। মোটামুটি বাস, অটো, ট্রেকার, ভ্যান, রিক্সায় কাজ মিটে যায়।
একবার এক নেমন্তন্ন এলো দুর্গানগর থেকে। আমার কাকার সহপাঠী বন্ধুর বাড়ি দুর্গানগরে। বাড়ি ফাঁকা করে সকলে নেমন্তন্ন খেতে যাওয়া সম্ভব না, তাই কাকা বাড়িতে থেকে গেল আর কাকিমা, আমি, দিদি, বোন আর ভাই গিয়েছিলাম দূর্গানগরে। বারাসাত স্টেশন পর্যন্ত কাকা নিজে এসে ট্রেনের টিকিট কেটে আমাদের সব কিছু বুঝিয়ে দিয়েছিলো। দূর্গানগরের আগের স্টেশনের নাম? কটা স্টেশন পরে দূর্গানগর? স্টেশন থেকে নেমে কোন দিকে যেতে হবে? কি ভাবে পৌঁছাবো সব কিছু সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছিল তোতাপাখির বুলির মত। আমরাও সকলে তোতাপাখির মতো সব কিছু মুখস্ত করে ফেললাম।
আমরা পাঁচজন, ট্রেনের টিকিট পাঁচ জনের, বারাসাত থেকে দুর্গানগর। একটাই টিকিট ওতেই পাঁচ জনের। আমি একবার টিকিটটা হাতে নিয়ে দেখে নিলাম, দেখলাম আমাদের কারো নাম লেখা নেই তাতে। কাকিমাকে টিকিটটা ফেরৎ দিয়ে আমারা সকলেই ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি। হঠাৎ আমাদের মধ্য থেকে কেউ একজন প্রশ্ন তুললো যে, ফেরার সময় আবার টিকিট কাটতে হবে তো? কাকা খুবই স্বাভাবিক ভাবে বলেছিল, না না এই টিকিটের হয়ে যাবে। কাকার মুখ থেকে এটা শোনার পর আমাদের মনে আর কোনো প্রশ্ন আসেনি।
যথা সময়ে প্লাটফর্ম কাঁপিয়ে শিয়ালদা গামী ট্রেন এলো বারাসতের তিন নম্বর প্লাটফর্মে। আমারা অতি সাবধানে সকলে সকল রকম নিয়ম মেনে ট্রেনে উঠে পড়লাম। ট্রেনে আর বিশেষ কোনো ঘটনা ঘটেনি। দূর্গানগর পৌঁছে ট্রেন থেকে নেমে আত্মীয়ের বাড়ি পৌঁছাতেও আর কোনো অসুবিধা হয়নি।
সারাদিন খাওয়া দাওয়া, হইহুল্লোড় করে দিন কেটে গেলো। বিশেষ কোনো ঘটনার মধ্যে তেমন কিছু আর নেই। শুধু মাত্র আমার একটা ছোট্ট ভুল ছাড়া। ছোটবেলা থেকে খাওয়ার পরে থালার মধ্যে হাত ধোয়া আমার কাছে অতি সাধারণ ঘটনা। কে জানতো যে খাওয়ার পরে থালায় হাত ধুতে নেই, বেসিনে হাত ধুতে হয়। আমাদের বাড়িতে টেবিল চেয়ারে বসে ভাত খাওয়ার চল বা ব্যবস্থা কোনোদিনই ছিল না। ছোট থেকেই খেজুর পাতার হাতে বোনা চাটাইয়ে বসে ভাত খেয়ে বড় হয়েছি। খাওয়ার পরে থালায় হাত ধুয়ে উঠে পরেছি। সেদিনও আমি নির্বোধের মতো থালায় হাত ধুয়েছিলাম। আমার হাত ধোয়া নিয়ে ওদের চোখে মুখে একটা বিরক্তের ছাপ দেখেছিলাম। নিজেকে কেমন যেন অপরাধী মনে হয়েছিল। হাত ধোয়ার পর থেকে ওই আত্মীয়ের বাড়ি ছাড়া পর্যন্ত আমি কেমন যেন একটা অপরাধবোধে ভুগেছিলাম।
বিকালে এবার ফেরার পালা। এদিকে দূর্গানগর স্টেশন পর্যন্ত কাকার বন্ধু আমাদের কে পৌঁছে দিয়ে গেলেন। উনি ট্রেনের টিকিট কেটে দিতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু আমার বারণ করে বলেছিলাম যে টিকিট কাটা আছে। কাকিমা ব্যাগ থেকে টিকিট বার করে দেখিয়ে আমার কাছে রেখে দিতে বললো। যথা সময়ে ট্রেন এলো, আমরা অতি সাবধানে আবার ট্রেনে উঠলাম।
বারাসাত যখন পৌঁছালাম তখন সবে সন্ধ্যা নেমেছে। ট্রেন থেকে নেমে সকলে আমরা ক্লান্ত পায়ে একটু একটু করে foot bridge এর দিকে এগোচ্চি। দিদি, কাকিমা আর বোন আগে আগে, আমি আর ভাই একটু পিছনে। আমি দেখতে পেলাম কাকিমা, দিদি আর বোন foot bridge এ উঠে গিয়েছে, এই দেখে আমি একটু পা চলিয়ে তাড়াতাড়ি হাটতে শুরু করেছিলাম। আমার এক পা foot bridge এ দিয়েছি, ওমনি একজন মাঝ বয়সী ভদ্রলোক আমাকে থামিয়ে বললেন, টিকিট?
জীবনে প্রথম এই TT দেখলাম। পায়ে কালো জুতো, পরনে অতি সাধারণ প্যান্ট ও শার্ট, কাঁধে একটা কালো চৌকো ব্যাগ। মাথায় টাক, চোখে চশমা, হাতে কলম। জামার পকেটে একটা স্টিলের batch লাগানো। বিশ্বাস করুন, আমি একটুও ভয় পাইনি। আমি তো জানতাম যে আমার পকেটে টিকিট আছে। কাকা তো বলেছিলো, ওই টিকিটের হয়ে যাবে। আমি ঠোঁটের কোণে একটা কৃত্তিম তাচ্ছিলেই হাসি এনে পকেটে হাত ঢুকিয়েছিলাম টিকিট বার করার জন্য।
টিকিটা TT এর হাতে দেওয়া মাত্রই TT আমার বাম হাতটা শক্ত করার ধরলো। আমি কিছুই বুঝতে না পেরে নিজের অজান্তেই হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করেছিলাম। হাতটা একটু নাড়াচাড়া করতেই বাঁধনটা যেন আরো কোষে গেলো। TT বলে উঠলো, এটা তো যাওয়ার টিকিট? আসার টিকিট কই? আমার মাথায় ঝনাৎ করে বাজ পড়লো। আমি আমতা আমতা করে বললাম, ওটাই তো যাওয়া আসার টিকিট! আমার এই কথা শুনে TT আর কথা না বাড়িয়ে আমাকে হিড়হিড় করে প্লাটফর্মের একটি ঘরে নিয়ে গেল।
সেই প্রথম আমি জানতে পারলাম, যে one-way আর two-way টিকিট আলাদা আলাদা হয়। কাউন্টারে গিয়ে যদি বলি রিটার্ন টিকিট ( Return Ticket ), তবেই two-way টিকিট দেয় double ভাড়া নিয়ে। আমাকে ফাইন দিতে হলো। TT ৬১ টাকার চালান কেটে আমাকে দিয়েছিল। মানিব্যাগের গোপন চোরা পকেট থেকে অতি কষ্টে জমানো ১০০ টাকার ভাঁজ করা নোটটা সেদিন বার করে দিয়েছিলাম।
সেই ৬১ টাকার চালান আমার জীবনের প্রথম ট্রেনের ফাইন এবং শেষ ফাইন। তার পর বহু বছর সেই ৬১ টাকার চালান মানিব্যাগে বয়ে বেড়িয়েছিলাম। বহুবার ব্যাগ পাল্টেছি কিন্তু ৬১ টাকার চালান নতুন ব্যাগে যত্নে তুলে রেছেলিয়াম। যেবার ২০০৯ সালে দমদম junction এ আমার পকেট মার হলো, সেবার আমার Nokia 7210 আর মানিব্যাগ দুটোই গিয়েছিলো। সেই প্রথম, সেই শেষ!
সঞ্জয় হুমানিয়া
২২ মার্চ ২০১০, ডোমকল, মুর্শিদাবাদ, ইন্ডিয়া
★ আমার লেখায় অজস্র বানান ভুল থেকে যায়, পাঠকের চোখে পড়লে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন ★
Nice post !!!